* পুরোপুরি বাতিল হতে পারে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
* বাড়ছে না করমুক্ত আয়সীমা
* সুবিধা হারাতে পারে বড় রফতানি খাত
* পোশাকশিল্প খাতে করহার ১৮-২০ শতাংশ চায় এনবিআর
* সবার জন্য ন্যূনতম কর ৫০০০ টাকা হতে পারে
* ভ্যাটের হার হতে পারে ১৫ শতাংশ
রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে যারা কর সুবিধা পেয়ে আসছিল, সেই সব কর অব্যাহতির লাগাম টেনে ধরা, কৃষিপণ্য বিপণনে উৎসে কর কমানো, এককভাবে ভ্রমণ কর আদায়, ব্যক্তিগত করহার বৃদ্ধি, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পুরোপুরি বাতিলসহ বাজেটে একগুচ্ছ সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৫৪ বছর পর এবারই প্রথম আগের বছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকুচিত মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয় কমানো ও বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য করতেই আকার কমানোর কথা বলছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়ার পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাজেটের এই আকার চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতে হ্রাসকৃত করহার উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। পাশাপাশি পোশাক খাতের কর সুবিধা তুলে নিতে পারে সরকার। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তার দাবি কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতের কর সুবিধা উঠিয়ে নিতে আগামী বাজেটে এ সংক্রান্ত তিনটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) বাতিল করা হচ্ছে। এসব খাতে সাধারণ করহার প্রযোজ্য হবে। তবে প্রান্তিক মৎস্যচাষিদের সুরক্ষা দিতে ৫ লাখ বা সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখার প্রস্তাব রাখা হতে পারে। এ কর সুবিধার আড়ালে অনেকেই কালো টাকা সাদা করেন বলে দাবি এনবিআর সংশ্লিষ্টদের। সুবিধার অপব্যবহার রোধে এসআরওগুলো বাতিল করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রান্তিক কৃষকদের সুবিধা দিতে ২০১৫ সালে কর সুবিধা দেওয়া হয়। পরে দেখা গেছে মন্ত্রী-এমপিরা খামারকে মূল আয় দেখিয়েছেন আয়কর নথিতে। এগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। নির্বাচনী হলফনামায় দেখা গেছে, মন্ত্রী-এমপিরা কেউ মাছ ব্যবসায়ী, কেউ মুরগি ব্যবসায়ী। এই সুবিধা আগামী বাজেটে থাকবে না।
পোশাক কারখানায় অস্থিরতা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, শিল্পকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সংকটের মুখে দেশের সর্ববৃহৎ রফতানিখাত পোশাকশিল্প। বাজেটে পোশাক শিল্পের করহার বাড়ানো হতে পারে। এতে পোশাক খাতের রফতানিতে আরও বাধা সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের করপোরেট করহার ১২ শতাংশ। সবুজ কারখানার জন্য এ হার ১০ শতাংশ। আর সুতা শিল্পের করহার ১৫ শতাংশ। সুতার ওপর কর অপরিবর্তিত থাকলেও পোশাক খাতে করহার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পোশাক খাতে করহার বাড়িয়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ করতে চায় এনবিআর।
বর্তমানে অর্থ আইন ও এসআরওর মাধ্যমে বিভিন্ন খাতের জন্য বিভিন্ন রকমের করপোরেট করহার নির্ধারণ করা আছে। এনবিআরের পরিকল্পনা একক হারে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে কর আদায় করা। একক হারে করপোরেট কর ও ভ্যাট নির্ধারণ করতে উল্টো ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব দিতে পারে এনবিআর। সেক্ষেত্রে ভ্যাটের হার হতে পারে ১৫ শতাংশ, আয়করের হার এখনো চূড়ান্ত করেনি এনবিআর। শিগগির প্রাক-বাজেট আলোচনার চূড়ান্ত সভা হবে এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে। সেখানে এই প্রস্তাব দিতে পারে এনবিআর।
বর্তমানে সিগারেট-বিড়ি-জর্দা-গুলসহ তামাকজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ, পাবলিক ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, নন-পাবলিক ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ, ট্রাস্টের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হওয়া পাবলিক ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১০ শতাংশের কম শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হওয়া পাবলিক ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ, কোম্পানি আইনের অধীন এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, পাবলিক ট্রেডেড ব্যাংক, বিমা, ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, নন-পাবলিক ট্রেডেড ব্যাংক, বিমা, ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ব্যক্তিসংঘের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, সমবায়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, বস্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, পাটজাত শিল্পের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ, শাখা-লিয়াজোঁ অফিস ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার ক্ষেত্রে করহার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে শর্ত পূরণ করলে কিছু ক্ষেত্রে করহার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
এনবিআর সংশ্লিষ্টদের দাবি, পোশাকখাত যদি ১২ শতাংশের বেশি কর দেয় তাহলে স্ট্যান্ডার্ড রেটে কর দিতে আপত্তি কোথায় তাদের? অটোমেশন হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আগামীতে নিজের অ্যাকাউন্টে অগ্রিম কর ফেরত পাবেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, করপোরেট করহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে এনবিআরের সরে যাওয়া উচিত হবে না। কর খাতের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে বিভিন্ন ধরনের নগদ সহায়তা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সিপিডি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না। ব্যক্তি শ্রেণির ন্যূনতম কর বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে সরকারের। সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া সারাদেশের সবার জন্য ন্যূনতম কর একই সমান করা কিংবা কাঠামো আগের মতো রেখে ন্যূনতম করের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা যাচাই-বাছাই করছে এনবিআর।
এখন দেশের বিভিন্ন এলাকা ভেদে ব্যক্তির ন্যূনতম কর একেক রকম। যেমন : বর্তমানে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ন্যূনতম করের পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকা। অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় এই করের পরিমাণ চার হাজার টাকা। আর সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকায় ব্যক্তির ন্যূনতম কর তিন হাজার টাকা। সারাদেশে সবার জন্য ন্যূনতম কর একই করলে তা হতে পারে পাঁচ হাজার টাকা। আবার আগের কাঠামো ধরে রাখলে সেই পরিমাণ বেড়ে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ন্যূনতম কর বাড়ানো উচিত হবে না। এনবিআরের ওপর কর আহরণের একটা চাপ আছে। মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। ন্যূনতম কর বাড়ানো হলে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। বর্তমানে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। পরবর্তী এক লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী চার লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ ও অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহায়ক কমিটির সদস্য অনন্ত ক্লথিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এনামুল হক বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। এর মধ্যে করহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা আগে যে হারে কর দিতাম, সেই হারেই দিতে চাই।
নিট পোশাক খাতের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাজেটে করপোরেট করহার বাড়ানো এ খাতের জন্য অবিচার হবে। ১২ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমরা আরও বেশি করপোরেট কর দেই। সরকার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অগ্রিম কর আদায় করে। সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। এই মুহূর্তে করহার বাড়ানোও হবে অযৌক্তিক।
এনবিআরের সদস্য (করনীতি) এ কে এম বদিউল আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কর সুবিধা ভোগ করে আসছে পোশাক খাত। অন্যান্য খাতের সঙ্গে করপোরেট করহারে বৈষম্য দূর করতে এনবিআর এ বিষয়ে ভাবছে। এখনো কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, এসব খাতে ২০১৫ সালে করারোপ শুরু হয়েছে। এসব খাত আগে সম্পূর্ণ করমুক্ত ছিল। এবার কী হবে, সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

আসন্ন বাজেটে একগুচ্ছ সাহসী সিদ্ধান্ত
- আপলোড সময় : ২৮-০৪-২০২৫ ০৮:১৮:১৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৮-০৪-২০২৫ ০৮:১৮:১৩ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ